রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত

রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট আগামী বছর থেকে উৎপাদন শুরু করার কথা রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবি এখনো বিদ্যুতের সম্ভাব্য শুল্ক নিয়ে নিশ্চিত নয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিপি) কর্মকর্তারা প্ল্যান্টের সম্ভাব্য বিদ্যুৎ শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠকে বসেন। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য পাননি।বিএইসি ২৪০০ এমডব্লিউ আরএনপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং বিপিডিবি একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় রাশিয়ার সহায়তায় নির্মাণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিএইসি’র সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা বিপিডিবি’র কিছু কর্মকর্তার বরাতে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য জানানোর ব্যাপারে আরএনপিপি কর্মকর্তাদের মধ্যে খুবই অনীহা দেখা যায়।তিনি বলেন, ‘খরচের সঠিক তথ্য জানা না থাকলে কেন্দ্রের বিদ্যুতের শুল্ক গণনা করা সত্যিই কঠিন।’তিনি আরো বলেন, বিএইসি কর্মকর্তারা প্ল্যান্টের প্রয়োজনীয় তথ্য ও খরচ সম্পর্কে জানাতে ইচ্ছুক নন।

‘ইস্যুটি খুবই সংবেদনশীল’ হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিপিডিবি কর্মকর্তারা বিএইসিকে তাদের খরচের কিছু তথ্য যথাযথ নথিসহ জানাতে বলেছিলেন। বিশেষ করে বিদেশী ঋণ, সুদ, পরিশোধের সময়সূচি, জ্বালানি সরবরাহের খরচ, নির্দিষ্ট খরচ, পরিচালনা ব্যয় এবং আরএনপিপির প্রতিষ্ঠা খরচ।’তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিএইসি কর্মকর্তারা এই তথ্যগুলো বিপিডিবিকে জানায়নি।’

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেছেন, বিপিডিবি ও বিএইসি উভয়ই শুল্ক সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা করছে।তিনি বলেন, আরএনপিপির প্রথম ইউনিটটি ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিক থেকে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।তিনি বলেন, ‘সুতরাং, শুল্ক বিষয়ক সমাধানের জন্য এখনো যথেষ্ট সময় আছে এবং আমরা সেই সময়ের আগেই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ব্যাপারে আশাবাদী।’

বিপিডিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা বিএইসির সাথে আলোচনা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রাথমিক হিসাব করেছেন। সে হিসাবে আরএনপিপির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের শুল্ক ১০ টাকার কম হবে না।’ওই কর্মকর্তা বলেছেন, প্রথম থেকেই লেভেলাইজড ট্যারিফ বা বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের সম্ভাব্য উৎপাদন খরচ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।

আরএনপিপি প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে এর কর্মকর্তারা বলেছিলেন, শুল্ক হবে প্রায় শূন্য দশমিক ০৪ ডলার বা ৪ সেন্ট। অর্থাৎ প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টা ৩ টাকা ৫০ পয়সা, যখন মার্কিন ডলারের দাম ৮০ টাকার কম ছিল।আরএনপিপি কর্মকর্তাদের পাঠানো কাগজপত্রে রাশিয়ান বিশেষজ্ঞরা আরো কম শুল্কের কথা বলেছিলেন।তারা জানিয়েছিলেন, শুল্ক প্রায় শূন্য দশমিক ০৩১৯ বা ৩ দশমিক ২ সেন্ট হতে পারে।

আরএনপিপির প্রকল্প পরিচালক এবং নবগঠিত নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ শওকত আকবর এর আগে কথা বলার সময় ধারণা দিয়েছিলেন যে শুল্ক শূন্য দশমিক ০৪ ডলারের মধ্যে হবে।তিনি বলেন, ৫০ বছরের স্থিতিশীল জ্বালানির দাম, ৫০ বছর পরিচালনার মেয়াদ এবং মূলধন বিনিয়োগ ব্যয়ের উপর ভিত্তি করে আরএনপিপির হিসাব করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, প্রকল্পের ডিসকাউন্ট রেট কম থাকলে শুল্ক কম হয়। এছাড়া, প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর বা প্ল্যান্টের গড় বিদ্যুৎ পরিবহনের সাথে তার নির্ধারিত সক্ষমতার অনুপাত ৯৩ শতাংশ গণনা শুল্ক কম হওয়ার আরেকটি কারণ।কিন্তু স্থানীয় বিদ্যুতের শুল্ক বিশেষজ্ঞরা এই হিসাবের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন এবং বলেছেন, এই অনুমানের চেয়ে শুল্ক অনেক বেশি হবে।

কিছু স্থানীয় বিশেষজ্ঞের হিসাব অনুযায়ী আরএনপিপি প্রকল্পের বিদ্যুতের শুল্ক শূন্য দশমিক ০৮ ডলার থেকে শূন্য দশমিক ১০ ডলারের (৮-১০ মার্কিন সেন্ট) বেশি হবেদেশের বিশিষ্ট বিদ্যুৎ শুল্ক বিশেষজ্ঞদের একজন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক সদস্য মিজানুর রহমান বলেছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের শুল্ক হবে শূন্য দশমিক ০৮৫ ডলারের (৮ দশমিক ৫ সেন্ট) বেশি।বিপিডিবির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান মনে করেন, শুল্ক আরএনপিপির হিসাবের দ্বিগুণেরও বেশি হবে।

নির্মাণ ব্যয় ১৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার (১২ দশমিক ৬৫ ডলার এবং ৫০০ মিলিয়ন সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন ব্যয়), ৫০ বছরের জ্বালানির মূল্যসহ ৫০ বছরের অপারেশন ও ডিকমিশনিং এবং ব্যয়িত জ্বালানি রাশিয়ায় পাঠানোর ব্যয়ের ভিত্তিতে তার নিজের করা হিসাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি মার্কিন ডলারের দাম ১০৯ টাকা হারে ধরা হয়, তবে শুল্ক হবে প্রায় শূন্য দশমিক ০৮৫ ডলার বা প্রতি ইউনিট ৯-১০ টাকার মধ্যে।তিনি আরো বলেন, ‘আর ডলারের দর আরো বাড়লে, শুল্ক প্রতি ইউনিট ১০ টাকার বেশি হবে।’তিনি বলেন, ঋণ পরিশোধের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ হবে ১২-১৩ সেন্ট এবং তারপর তা কমে ৫-৬ সেন্টে নেমে আসবে।

তিনি বলেন, যতদিন না বাংলাদেশ পারমাণবিক বর্জ্য মোকাবিলায় কিছু দক্ষতা অর্জন করে ততদিন রূপপুরের মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহৃত জ্বালানির বর্জ্য রাশিয়ান ফেডারেশনে পাঠানো হবে। পারমাণবিক শক্তি নিষ্ক্রিয় করা একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বিদ্যুতের দাম নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তিনি বলেন, ‘সঠিকভাবে না জেনে শুল্ক সম্পর্কে মন্তব্য করা বুদ্ধিমানের কাজ না।’

শুল্ক হিসাবের সময় বিপিডিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ২০২৭ সালের মার্চ থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করবে। বার্ষিক ১ দশমিক ৩৬০ বিলিয়ন ডলার হারে পরবর্তী ২০ বছরে ৪০টি কিস্তিতে সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করা হবে।তিনি আরো বলেন, ‘আসল ও সুদসহ গড়ে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হবে।’সরকার ২০০৯ সালে আরএনপিপি প্রকল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করে এবং ২০০৯ সালের ১৩ মে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে 'পারমাণবিক জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার' বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে।

২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তুতি পর্যায়ের নির্মাণ কাজের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রাষ্ট্রীয় রপ্তানি ঋণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়।রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকার ২০১৫ সালে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাধারণ চুক্তি (জিসি) সই করে।চুক্তি অনুসারে প্রতিটি ইউনিট ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।

বাংলাদেশ ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আরএনপিপি’র জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১১ দশমিক ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার জন্য একটি ঋণচুক্তি সই করে। প্রকল্পের ব্যয়ের ৯০ শতাংশই এই অর্থের মাধ্যমে নির্বাহ করা হবে।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে, প্ল্যান্টের প্রথম ইউনিটটি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০১৫ সালের জুলাই মাসে চালু হতে পারে।

সূত্র : ইউএনবি