র‍্যাম্বো, রকেট ম্যান, শয়তান - জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের স্মরণীয় সব মুহুর্ত

র‍্যাম্বো, রকেট ম্যান, শয়তান - জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের স্মরণীয় সব মুহুর্ত

র‍্যাম্বো, রকেট ম্যান, শয়তান - জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের স্মরণীয় সব মুহুর্ত

এ বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম সভা শুরু হতে যাচ্ছে আগামীকাল অর্থাৎ ১৮ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাতে যোগ দিতে গেছেন।

উনিশশো পয়তাল্লিশ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৬ সালে প্রথমবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সাধারণ পরিষদের বৈঠক।কয়েকদিন ধরে চলমান এই সভার কার্যক্রম সাধারণত প্রথাগত নিয়ম-কানুন ও রীতি-রেওয়াজ মেনেই সম্পন্ন হয়। কিন্তু কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও ঘটে থাকে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় সদস্য দেশের শীর্ষ নেতা বা তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়ে থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই এই সভায় বক্তব্য দেয়া বা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীরা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলেন।তবে এ সভায় শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্য করা, অন্য কোনো দেশ বা দেশের নেতার প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলা বা অশোভন আচরণের ঘটনাও একাধিকবার ঘটেছে।সেরকম কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।

নিকিতা ক্রুশ্চেভের জুতা কাণ্ড, ১৯৬০

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৬০ সালের সভায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের অভিনব ‘প্রতিবাদ’ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

সেসময় সাধারণ পরিষদের এক বৈঠকে ফিলিপিন্সের একজন প্রতিনিধি তার বক্তব্যের সময় পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত নীতির সমালোচনা করেন।ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ শুরুতে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তার আসনের সামনের টেবিলে আঘাত করতে থাকেন।

এরপর এক পর্যায়ে মি. ক্রুশ্চেভ তার ডান পায়ের জুতা খুলে বারবার টেবিলে আঘাত করে প্রতিবাদ জানান।এই ধরণের প্রতিবাদের কোনো ব্যাখ্যা সেসময় তিনি না দিলেও তার জীবনী গ্রন্থ ‘ক্রুশ্চেভ - দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ এরা’ বইয়ে তিনি স্বীকারোক্তি দেন যে ‘জোরালো প্রতিবাদ’ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই সেসময় তিনি জুতা দিয়ে টেবিল চাপড়ানোর মতো কাণ্ড করেছিলেন।

ফিদেল ক্যাস্ত্রোর দীর্ঘতম ভাষণ, ১৯৬০

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রত্যেক দেশের নেতা বা প্রতিনিধিদের বক্তব্য ১৫ মিনিটের মধ্যে সমাপ্ত করার অনুরোধ করা হয়। যদিও এ রীতি অধিকাংশ সময়ই মানা হয় না।সাধারণ পরিষদে অনেক দেশের নেতারই কয়েক ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ ভাষণ দেয়ার নজির রয়েছে।তবে লম্বা বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ১৯৬০ সালের দীর্ঘ ভাষণের রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেননি।

সে বছর প্রথমবার সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দিতে গিয়ে কিউবার নেতা সাড়ে চার ঘণ্টা বক্তব্য দেন, যা এখনো পর্যন্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় দীর্ঘতম বক্তব্য দেয়ার রেকর্ড।তবে সাধারণ পরিষদের দীর্ঘতম ভাষণের রেকর্ড ফিদেল ক্যাস্ত্রোর দখলে হলেও জাতিসংঘের ইতিহাসে দীর্ঘতম ভাষণ দেয়ার কৃতিত্ব কিন্তু তার দখলে নয়।

এর আগে ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের প্রতিনিধি দলের চেয়ারম্যান কৃষ্ণ মেনন কাশ্মীর ইস্যুতে আট ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বক্তব্য রেখেছিলেন।সে বছর ২৩ ও ২৪শে জানুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি বৈঠকজুড়ে তিনি একাই বক্তব্য দিয়েছিলেন। বক্তব্য দেয়ার সময় এক পর্যায়ে তাকে হাসপাতালে নিতে হয় এবং কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল থেকে ফেরত এসে তিনি তার বক্তব্যের শেষ এক ঘণ্টা পেশ করেন।সেসময় একজন চিকিৎসক তার রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

আরাফাতের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান, ১৯৭৪

প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নেতা ইয়াসির আরাফাত প্রথমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় বক্তব্য রাখেন ১৯৭৪ সালে।ওই বক্তব্যে তিনি এমন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে পারবে।

কোনো দেশ বা রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব না করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তব্য দেয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন ইয়াসির আরাফাত।তার আগে ১৯৬৫ সালে পোপ ষষ্ঠ পল প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছিলেন কোনো রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব না করে।

তার ঐ বক্তব্যে ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, “আমি এখানে শান্তির প্রতীক হিসেবে জলপাই গাছের শাখা এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার বন্দুক নিয়ে এসেছি। আমার হাত থেকে জলপাই শাখা পড়ে যেতে দিও না।”ইয়াসির আরাফাত তার বক্তব্যের সময় কয়েকবার ইসরায়েলের নাম নিলেও অধিকাংশ সময়ই তাদের ‘জায়োনিস্ট স্বত্ত্বা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

সে বছর সাধারণ পরিষদের সভায় ইসরায়েলের প্রতিনিধি ছিলেন ইয়োসেফ তেকোয়াহ, যিনি তার বক্তব্যে পিএলও’র সদস্যদের ‘হত্যাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে ‘আরাফাত আজও ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করার নাৎসি পদ্ধতি পছন্দ করেন।’ফিলিস্তিনের কোনো অঞ্চলে ইসরায়েল পিএলও’র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দেবে না বলেও তার বক্তব্যে বলেছিলেন মি. তেকোয়াহ।

ড্যানিয়েল ওর্তেগার ‘র‍্যাম্বো’ মন্তব্য, ১৯৮৭

নিকারাগুয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওর্তেগা সাধারণ পরিষদের ১৯৮৭ সালের সভায় যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতির সমালোচনা করে দেয়া এক মন্তব্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সমালোচনা করেন।তাতে তিনি হলিউড সিনেমা ‘র‍্যাম্বো’র উদাহরণ টেনে আনেন।

যুক্তরাষ্ট্র সেসময় নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে – এমন অভিযোগ তুলে প্রেসিডেন্ট ওর্তেগা বলেন, “প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকে যারা সেনা কার্যক্রম চালাতে বা অন্য দেশে আক্রমণ করতে পরামর্শ দেয়, তাদের সাথে আলোচনা করার আগে তার মনে রাখা উচিৎ যে র‍্যাম্বো শুধু সিনেমাতেই বিরাজ করে।”নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল সভা কক্ষ থেকে হেঁটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

হিউগো শ্যাভেজের ‘শয়তান’ মন্তব্য, ২০০৬

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিউগো শ্যাভেজ ২০০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে ‘শয়তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন।

সাধারণ পরিষদে দেয়া মি. শ্যাভেজ তার বক্তব্যের সময় মার্কিন বিদেশ নীতির সমালোচনা করে লেখা একটি বই হাতে নিয়ে বলেন, “শয়তান তাদের মধ্যেই (আমেরিকার মানুষের) আছে।""আমি যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, গতকাল শয়তান (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট) এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলেছে।”সে বছর হিউগো শ্যাভেজের বক্তব্যের আগের দিনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জাতিসংঘের সাধারণ সভায় বক্তব্য রেখেছিলেন।

মুয়াম্মার গাদ্দাফির সনদ ছুঁড়ে ফেলা, ২০০৯

উনিশশো উনসত্তর সালে লিবিয়ায় ক্ষমতা নেয়ার ৪০ বছর পর প্রথমবারের মতো মুয়াম্মার গাদ্দাফি জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অংশ নেন ২০০৯ সালে।

গাদ্দাফি তার ভাষণে অভিযোগ তোলেন যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা জাতিসংঘের মূলনীতি ভঙ্গ করছে।ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে ‘সন্ত্রাসী পরিষদ’ হিসেবেও উল্লেখ করেন।সে বছর গাদ্দাফি তার ৯৬ মিনিটের ভাষণে জাতিসংঘের সনদ থেকে কয়েক লাইন পাঠ করেন এবং এক পর্যায়ে সনদের একটি পাতা ছিড়ে ফেলেন।

পরে তার হাতে থাকা জাতিসংঘ সনদটি ছুঁড়েও ফেলে দেন তিনি।মজার বিষয় হল, মুয়াম্মার গাদ্দাফির আরবি ভাষায় দেয়া ভাষণের ৭৫তম মিনিটে তার অনুবাদক অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।মি. গাদ্দাফির ভাষণের শেষ ২০ মিনিট অনুবাদ করেন জাতিসংঘের আরবি ভাষা অনুবাদ বিভাগের প্রধান।

আহমেদিনেজাদের বক্তব্যের প্রতিবাদ, ২০১০-২০১১

সাধারণ পরিষদের সভায় কোনো নেতার বক্তব্যের প্রতিবাদ হিসেবে অন্য দেশের প্রতিনিধিদের হেঁটে বের হয়ে যাওয়ার ঘটনা আগে ঘটলেও, ২০১০ এবং ২০১১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের সময়কার ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব।ওই দুই বছরই ইরানি প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের এক পর্যায়ে একাধিক পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধি সভা কক্ষ ত্যাগ করেছিলেন।

দুই হাজার দশ সালে মি. আহমেদিনেজাদ অভিযোগ তুলেছিলেন যে, ২০০১ সালে ১১ই সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে বোমা হামলার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রই সাজিয়েছে।আর ২০১১ সালে তিনি ইউরোপের ওপর অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে।

ট্রাম্পের ‘রকেট ম্যান’ মন্তব্য, ২০১৭

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের সাধারণ সভায় উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আনকে উদ্দেশ্য করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা সাড়া ফেলেছিল বিশ্বব্যাপী।মি. ট্রাম্প তার বক্তব্যে বলেছিলেন, “রকেট ম্যান নিজের এবং তার দেশের জন্য আত্মঘাতী মিশনে নেমেছেন। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি আছে, তবে আশা করি তার দরকার হবে না।”

তিন মাস বয়সে সাধারণ সভায় অংশগ্রহণ, ২০১৮

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন ২০১৮ সালে তার তিন মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দিতে যান।মিজ আরডার্নের শিশু সন্তানের অংশগ্রহণকে বলা হয় জাতিসংঘের সাধারণ সভায় সর্বকনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তির অংশগ্রহণ।

জেসিন্ডা আরডার্ন ২০১৭ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী নারী সরকার প্রধান। সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩৭ বছর।দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পরেই এক সন্তানের জন্ম দিয়ে তিনি হন বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মা হয়েছেন।এর আগে ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।

একমাত্র ভার্চুয়াল সভা, ২০২০

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে। ঐ বৈঠকে কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি নিরসন, জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করেন নেতারা।এখন পর্যন্ত এটিই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ইতিহাসে একমাত্র ভার্চুয়াল বৈঠক।

সূত্র : বিবিসি