মুসলিম ছেলে শিশুর খৎনার সঠিক বয়স কত?

মুসলিম ছেলে শিশুর খৎনার সঠিক বয়স কত?

মুসলিম ছেলে শিশুর খৎনার সঠিক বয়স কত?

 “ঐ যে দেখো টিয়া পাখি, আমি উপরে তাকিয়ে পাখি খুঁজছিলাম, আর তখনই হাজাম কেটে ফেলে,” ছোটবেলায় নিজের খৎনা নিয়ে এমন অভিজ্ঞতার গল্প জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক।

বাংলাদেশের অনেক মুসলিম ছেলে বাচ্চাদের খৎনা নিয়েই এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, যাকে স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ 'মুসলমানি'ও বলে থাকেন।একটা দীর্ঘসময় ধরে এই কাজ বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে হাজামরা (যিনি খৎনা করেন) করে এসেছেন। তবে এখন হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা সার্জারির মাধ্যমে খৎনা করার চল বেড়েছে।

ছেলেদের যৌনাঙ্গের সামনের চামড়া কেটে অপসারণ করাকে খৎনা বলে। ওই চামড়া দিয়ে যৌনাঙ্গের অগ্রভাগ ঢেকে দেয়া হয়।ধর্মীয় কারণে মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদিরাও এই রীতি পালন করে থাকে। এছাড়া ধর্মীয় কারণ ছাড়াও চিকিৎসাগত কারণে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও ছেলে শিশুদের খৎনা করে থাকে।

কোন বয়সে খৎনা করানো উত্তম?

পশ্চিমা দেশে সাধারণত জন্মের পরপরই এটি করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণত দেখা যায় যে, বাচ্চারা একটু বড় হলে তারপর তাদের খৎনা করা হয়ে থাকে।এটি বিশ্বের প্রাচীনতম অস্ত্রোপচার পদ্ধতি এবং ধারণা করা হয় প্রায় ১৫,০০০ বছর আগে মিশরে এই প্রথা উদ্ভূত হয়েছিল। যদিও এনিয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য মেলেনি।

পৃথিবীর অনেক দেশে ছেলে শিশুর পাশাপাশি মেয়েশিশুরও খৎনা করানো হয়। তবে, অনেক দেশ আবার আইন করে সে প্রথা বন্ধও করেছে।বাংলাদেশে ছেলেশিশুরই কেবলমাত্র খৎনা করানো হয়। কিন্তু আসলে ঠিক কোন সময়টা খৎনা করার জন্য উপযুক্ত?এর কোনো নির্দিষ্ট বয়স আছে কি?

চিকিৎসকেরা অবশ্য জানান বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এর কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই।সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. হাসান শাহরিয়ার কল্লোল বিবিসি বাংলাকে বলেছেেন, “এর ফিক্সড কোনো সময় নেই যে এই সময় করলে ভালো আর এই সময় করলে খারাপ। যে কোনো বয়সে এটা করা যায়।”

“আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হল বাচ্চারা ক্লাস ওয়ান-টুতে ওঠার পর বাবা-মা তাদের নিয়ে আসে। তবে আমি বলবো এটা আরেকটু আগে করে ফেলাই ভালো। স্কুলে যাবার আগেই করতে পারে।”চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো নির্দিষ্ট বয়স না থাকলেও, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় তিন বা চার বছর বয়স খৎনার উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

তবে, অনেকে আরেকটু পরে করতে পছন্দ করেন, যেখানে ঘরোয়াভাবে খৎনা ঘিরে একটা উৎসব আয়োজন করা হয় এবং লক্ষ্য থাকে এটার একটা স্মৃতি যেন থেকে যায় শিশুটির কাছে।“আমার মনে আছে অনেক মানুষ এসেছিল, আমার একটু লজ্জাও লাগছিল, তবে অনেক উপহারও পেয়েছিলাম।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ যুবক নিজের খৎনার স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরেন।

তবে এটার একটা নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন ডা. হাসান।“সবার কিন্তু একটা বডি ইমেজ তৈরি হয়, অর্থাৎ নিজের নিজেকে দেখার চোখ। ছোটবেলায় সেই বডি ইমেজ ওভাবে ব্রেনে কাজ করে না, ফলে তখন অপারেশন করাটা সহজ। কিন্তু বাচ্চা বড় হলে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে।”তিনি পরামর্শ দেন একটু বোঝার বয়স হলেই খৎনা করে ফেলা ভালো।

এছাড়া স্কুল শুরু হলে বাচ্চার ব্যস্ততাও বেড়ে যায়, স্কুল ছুটির সাথে বাবা-মা’র সময় মিলিয়ে নিতে হয়। আবার বাচ্চার সামাজিক গন্ডিও বড় হয়, যেটা তার মননেও প্রভাব ফেলতে পারে।কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে তো জন্মের সাথে সাথেই খৎনা করে ফেলা হয়, বাংলাদেশে সেটি হয় না কেন?এই চিকিৎসক বলছেন, এখন সেটি হচ্ছে, যদিও তা সংখ্যায় খুবই কম।“আসলে বাচ্চার জন্মের সাথে সাথেই একটা অপারেশন, সেটা এখনো আমরা সামাজিক ও মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারি না,” বলেন ডা. হাসান।

স্বাস্থ্যগত সুবিধা

ডা. হাসান বলেন, “অনেকে কিন্তু ৪০ বছর বয়সেও করে, কারো হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে তখন মেডিকেল কারণে খৎনা করা লাগতে পারে।”

চিকিৎসাগত দিক থেকে খৎনার বেশ কিছু সুবিধা আছে, যে কারণে পশ্চিমা অনেক দেশও এই রীতি গ্রহণ করেছে।একদিকে এটা যেমন অনেক সময় চিকিৎসা হিসেবে কাজে লাগে আবার তেমনি রোগ প্রতিরোধেও উপকারী।“কতোগুলো মেডিকেল বেনিফিট আছে। যে অংশটা কেটে ফেলে দেয়া হয় সেখানে বেলানাইটিস বা ইনফেকশন হতে পারে। আবার যাদের কাটা হয় না তাদের এসটিডির ঝুঁকি বেশি থাকে,” বলেন এই সার্জারি বিশেষজ্ঞ।

হাজাম নাকি ডাক্তার?

“অবশ্যই, অবশ্যই ডাক্তার এবং এনেসথিশিয়া দিয়ে এটি করতে হবে,” জোর দিয়ে বলেন ডা. হাসান।তিনি বলেন, “যে কোনো ভাবেই হয়তো এটা করা যায়, হাজামরা যেভাবে করে তাতে হয়তো কোনো অসুবিধাও হচ্ছে না, কারণ মানব শরীর এমন কেটে ফেললে তা জোড়া লাগবেই। কিন্তু যদি ইনফেকশন হয়?”কিন্তু বাংলাদেশে তো বছরের পর বছর হাজামরা কাজটা করে এসেছেন, এখনো হাজার হাজার খৎনা এভাবে হচ্ছে !

“দেখুন একসময় তো অ্যানেসথিশিয়া ছাড়াই অপারেশন হতো, কিন্তু এখন কি আমরা সেটা কল্পনা করতে পারি?,” পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ডা. হাসান। “আগে ইনফেকশন হলেও অনেক সময় আমরা বুঝতে পারতাম না, এছাড়া টাইট করে বেঁধে দিলে তা ফুলে যেত, ফলে অনেক রকম সমস্যা হতে পারে।”এসব সমস্যা ঠেকাতে ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত পদ্ধতিতে খৎনা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

খৎনার ইতিহাস

শিশু বিশেষজ্ঞ বা পেডিয়াট্রিক সার্জন ও গবেষক আহমেদ আল সালেমের লেখা “অ্যান ইলাস্ট্রেটেড গাইড টু পেডিয়াট্রিক ইউরোলজি” বইয়ে এমন তথ্য পাওয়া যায়।আহমেদ আল সালেম তার বইতে ব্যাখ্যা করেছেন, অনেকে স্বাস্থ্যবিধি বা পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি বিবেচনা করে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আচার-অনুষ্ঠান পালন করার জন্য, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান করতে চান।সেইসাথে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের চিহ্ন হিসাবে খৎনাকে তাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

ওই বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, "অনেকের মতে, ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি, খৎনার স্বাস্থ্যকর উপযোগিতা এই সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।"কিন্তু এর আবির্ভাব স্বাস্থ্য উপকারিতার কথা ভেবে হয়েছে, নাকি এটি পুরোপুরি ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়না।যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা সংস্থা ইউএসএইডের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ১৫ বছর বয়সের বেশি ৩৩ শতাংশ পুরুষের খৎনা করা। খৎনা করা প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয় দশমিক তিন জন মুসলিম, এবং এক জনের কম ইহুদি।

সূত্র : বিবিসি