গৌরবের ৫৪ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

গৌরবের ৫৪ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ফাইল ছবি

দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ৫৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী শুক্রবার। স্বাধীনতার সমবয়সী এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ এবং সাংস্কৃতিক জাগরণে জাতির অন্যতম প্রতিভূ হিসেবে কাজ করছে। 

১৯৭০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে দেশের প্রথম ও একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৭৩ সালে এটির নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ থেকে এর নামকরণ করা হয়। প্রথম ব্যাচে মাত্র ৪টি বিভাগ ও ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৬টি অনুষদ ও ৩টি ইনস্টিটিউটের অধীনে ৩৭টি বিভাগে ১২ হাজার ৫৩৩ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করেন। বিশাল সংখ্যক এসব শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ২১টি আবাসিক হল।

শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূরীকরণের পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়টি এগিয়ে। আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনডেক্স ওয়েবসাইট ‘স্কোপাস’র তথ্যমতে, ১৯৭৪ থেকে ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাবি থেকে আন্তর্জাতিক জার্নালে ৫ হাজার ১১৭টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া, কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও বিশ্বসেরা ২% গবেষকের তালিকায় জাবির ৬ জন শিক্ষক ও ১জন শিক্ষার্থী স্থান পেয়েছেন। ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ র‍্যাংকিংয়ে প্রথম বারের মতো নাম ওঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। এ তালিকা অনুযায়ী শিক্ষা ও গবেষণায় দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে জাবি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা উঁচু করে আছে। দেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’, ভাষা আন্দোলনের স্মরণে নির্মিত ‘অমর একুশে’ ভাস্কর্য ও গ্রিক থিয়েটারের আদলে নির্মিত ‘সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ’ জাবিতেই অবস্থিত। যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া, ঋতু ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসেবে ডাকা হয়। বিশেষ করে শীতের সময় সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। হিম উৎসব এর মধ্যে অন্যতম। বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতি তুলে আনা হয় এ উৎসবে। বাংলাদেশে পুতুলনাচের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণার জন্য পুতুল নাট্য গবেষণা কেন্দ্র জাবিতে প্রথম খোলা হয়। 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী হিসেবে খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট বড় ২৯টি জলাশয় রয়েছে। যেগুলোতে প্রতিবছর শীতের সময় হিমালয় ঘেঁষা দেশগুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি এসে থাকে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছরের আয়োজিত প্রজাপতি মেলা ও পাখিমেলার সুনাম দেশজুড়ে সমাদৃত। এছাড়া, বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাবির সংরক্ষিত বনাঞ্চল দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বহু শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, লেখক, রাজনীতিবিদের স্মৃতিধন্য হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াৎ মামুদ, হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আবু রুশদ মতিনউদ্দিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, ইতিহাসবিদ বজলুর রহমান খান প্রমুখ। এছাড়া, কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেলিম আল দীন, হুমায়ুন ফরীদি, শহীদুজ্জামান সেলিম, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন, ড. সৌমিত্র শেখর, ড. শরীফ এনামুল কবির, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিমসহ বহু দেশবরেণ্য ব্যক্তি রয়েছেন। 

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন উপলক্ষে শুক্রবার (১২ই জানুয়ারি) দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জাবি প্রশাসন। সকাল সাড়ে ৯টায় বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ চত্বরে সমাবেশ, ১০টায় জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ও আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। পরে বেলা ১১টায় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে রক্ত গ্রুপ নির্ণয় কর্মসূচি ও সন্ধ্যা ৭টায় সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া, দীনব্যাপী জহির রায়হান মিলনায়তনে চিত্র প্রদর্শনী ও কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া চত্বরে পিঠা মেলা অনুষ্ঠিত হবে। 

৫৪ বছরের দীর্ঘ পথচলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকে জাবি দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও কিছু সফলতা ব্যর্থতা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে অর্জনের কোন শেষ নেই। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর পূর্ণাঙ্গ আবাসিক রূপ নিয়েছে। অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে জাবি মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। শিক্ষা, গবেষণা, খেলাধুলা সবকিছুতে শিক্ষার্থীরা সুবিধা পাবে। আমি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাবিকে দেখতে চাই। এর জন্য, শিক্ষা-গবেষণা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে আমরা জোর দিচ্ছি।