‘পানামা রোগে’ শত শত একর জমির কলাগাছ মরে যাওয়ায় ঈশ্বরদীর কলা চাষিরা দিশেহারা

‘পানামা রোগে’ শত শত একর জমির কলাগাছ মরে যাওয়ায় ঈশ্বরদীর কলা চাষিরা দিশেহারা

ছবি- নিউজজোন বিডি

এম মাহফুজ আলম, পাবনা:কলা গাছে ‘পানামা ভাইরাস’র ব্যাপক আক্রমণে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার কলাচাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শ’ শ’ হেক্টর জমির কলাগাছ এ ভাইরাসে নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় অনেক টাকা খরচ করে চোখের সামনে হাজার হাজার কলাগাছ মরে যাওয়ায় কলা চাষিদের সব স্বপ্ন ভেস্তে গেছে।

কাঁদছেন কৃষকরা, কৃষকদের অভিযোগ কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের বার বার অবহিত করার পরেও একটি বারের জন্যও তারা মাঠে এসে পরামর্শ দেননি, বিষেজ্ঞরা বলছেন এই ভাইরাসের আজো কোনো প্রতিশোধক বের হয়নি, আক্রান্ত গাছ মাটিতে পুতে ফেলা অথবা আগুনে পোড়ানো ছাড়া উপায় নেই।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদী উপজেলায় এক হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে কলাগাছ লাগানো হয়েছে।

আবাদের মধ্যে লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে ১ হাজার ৮০০ হেক্টর কলা গাছের চাষ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কলা চাষে লাভ হওয়ায় এ ইউনিয়নের কামালপুর, দাদাপুর, লক্ষ্মীকুন্ডা, চরকুরুলিয়া, শান্তিনগরে কৃষকরা অন্যান্য ফসলের পরিবর্তে শুধু কলা আবাদ করেছেন।

মাঠ পরিদর্শনকালে লক্ষ্মীকুন্ডা ও দাদাপুর গ্রামের কলা চাষি ভুট্টা প্রামাণিক, সুজন বিশ্বাস, দুলাল বিশ্বাস, সদাই বিশ্বাস, ইসমাইল বিশ্বাস, সাইফুল ইসলাম, ইসরাইল হোসেন, মোতালিব সরদার ও গেদান সরদার জানান,“ অজ্ঞাতনামা ভাইরাস আক্রমণ করেছে কলা গাছে। ভাইরাসটি প্রথমে কলা গাছের পুরানো পাতায় আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে উপরে পৌঁছে কচি পাতায় আক্রমণ করে। এতে কলার পাতা বাদামী হয়ে যায় এবং কুঁচকে যায়। কয়েকদিন পর পাতা ঝরে যায়। কলা গাছের শিকড় বা কান্ডের ভাইরাস কলা গাছে হলুদ থেকে লাল আঁকাবাঁকা দাগ দিয়ে আক্রমণ করে। পরে গোড়ার নিচে ও ওপরে পচন ধরে গাছ মরে যাচ্ছে। এতে করে এই অঞ্চলে শত শত একর জমির হাজার হাজার কলাগাছ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

কলাচাষিরা আরো জানান,‘ কিছু  লোকের কলা বাগান সম্পূর্ণরূপে নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং কারো কারো কলা গাছের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভাইরাস দ্বারা মারা গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা ভাইরাস আক্রান্ত কলাগাছ কেটে স্তূপ করে রাখছেন। তাদের অভিযোগ, কৃষি বিভাগকে বারবার জানানোর পরও তারা একবারের জন্যও মাঠে আসেননি।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে পাবনা কৃষি সমম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক ড. মোঃ জামাল উদ্দিন বলেন, আমরা সাধ্যমত পরামর্শ দিয়েছি। আক্রান্ত গাছ ইউনিয়ন পর্যায়ের দপ্তরে এনে করণীয় সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করা হয়েছে। 

কৃষকরা এই প্রতিনিধিকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দেন কীভাবে এই ভাইরাস সর্বনাশ করছে,‘গাছ কাটার পর দেখা যায় ভেতরের সাদা অংশ কালো হয়ে গেছে। এছাড়াও, এই ভাইরাসে আক্রান্ত কলার উপরের অংশে কালো দাগ কলাকে অপুষ্টি ও স্বাদহীন কওে তোলে। ভাইরাস থেকে কলা গাছকে রক্ষা করা না হলে লোকসান এড়াতে শত শত কৃষক কলা চাষ বন্ধ করতে বাধ্য হবে।’

তারা বলেন, '৫-৬ বছর আগে উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলের জমিতে কলা চাষ শুরু হয়। প্রথম বছরে কৃষকরা প্রচুর লাভ হওয়ায় ধীরে ধীরে কলা চাষ সম্প্রসারিত হয়। এ বছর এ ইউনিয়নে প্রায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে কলা চাষ হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার অন্যান্য এলাকায় ৪০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। চরের জমিতে কলা চাষ বদলে দিয়েছে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন শত শত মানুষ।

কৃষকরা জানান, এখানে মেহেরসাগর, অমৃতসাগর ও মন্দিরা কলার চাষ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ৩৫০ থেকে ৪০০টি পর্যন্ত কলার চারা লাগানো হয়। প্রতিটি কলাগাছের জমির ভাড়া, সার-বীজ ও চাষর বাবদ ১৫০  থেকে ২০০ টাকা খরচ হয়। আর প্রতিটি কলার কাঠি (কাদি) ৩০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। চাষিরা প্রতি বিঘায় অন্তত ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ পান এবং অতিরিক্ত কলার ডাল (মুচি ও ভাদাল) সবজি হিসেবেও বাজারে বিক্রি হয়।

দাদাপুর গ্রামের কলা চাষি ভুট্টা প্রামাণিক বলেন, দাদা চর এলাকায় ১১ বছর ধরে কলা চাষ হচ্ছে। এ বছর আমি ৫০ বিঘা কলা চাষ করেছি। প্রতি বছর কলা চাষ করে ভালো লাভ পাই। কিন্তু এবার ভাইরাসের কারণে কলাগাছ মরে যাওয়ায় আমরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। এছাড়াও সার ও কীটনাশকের দাম বাড়ায় লোকসান  বেড়েছে। তিনি বলেন, ২০২৩ সাল থেকে ভাইরাসটি কলা বাগানে আক্রমণ শুরু করে। এবার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কলা বাগানে ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে। ভাইরাসের আক্রমণ থেকে কৃষকদের বাঁচাতে উপজেলা কৃষি অফিস কলা বাগানে এসে কৃষকদের ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিলে ব্যাপক ক্ষতি এড়ানো যেত।

একই গ্রামের কলাচাষি দুলাল বিশ্বাস বলেন, দশ বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছি। এখন ভাইরাসের আক্রমণে প্রতিটি কলা গাছ মরে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে সযতেœ লাগানো কলাগাছ মরতে দেখে খুব খারাপ লাগে।

একই গ্রামের আরেক কৃষক সুজন বিশ্বাস জানান, কৃষি কর্মকর্তাদের জানানোর পরও তারা আমাদেও ক্ষেতে এসে  কোনো সুষ্ঠু সমাধান দেননি, তাই আমরা কোনো পরামর্শ পাইনি।

দাদাপুর গ্রামের দুই ভাই সাইফুল ইসলাম ও ইসরাইল হোসেন জানান, ভাইরাসের আক্রমণে আমাদের কলা বাগানের বেশির ভাগ কলা গাছ ফেঁটে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে এসব গাছ কাটতে হচ্ছে। আমরা দুই ভাই ৩৫ বিঘা জমিতে কলা লাগাই। এই কলা গাছের প্রায় ৭০ শতাংশই ভাইরাসে ধ্বংস হয়ে গেছে।

ঈশ্বরদী কৃষি বিভাগ জানায়, রোগাক্রান্ত কলা গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। দুই-তিন বছর পর কলা চাষ বন্ধ করে  ইে জমিতে অন্যান্য ফসল ফলাতে হবে। এছাড়াও, চুন প্রয়োগ করে মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করে কলা গাছকে পানামা  রোগ থেকে মুক্ত রাখতে পারে।

লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামীমা খাতুন বলেন,'ভাইরাস আক্রান্ত কলাগাছের পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে এবং ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছি।'

পাবনার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডাঃ জামাল উদ্দিন এ প্রতিনিধিকে বলেন, পানামা রোগে আক্রান্ত কলা গাছ উপড়ে মাটিতে পুতে রাখতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কারণ আক্রান্ত গাছ স্তূপ করে রাখলে জীবাণু বেশি ছড়িয়ে পড়বে। কলার ভাইরাসের আক্রমণ এড়াতে তিনি কৃষকদের ভালো ও পরিষ্কার কলার চারা লাগানোর পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশ সুগারক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএসআরআই) প্যাথলজি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন,“পানামা রোগ (ফুসারিয়াম উইল্ট) একটি উদ্ভিদ রোগ যা কলা গাছকে সংক্রমিত করে।”

এটি ফুসারিয়াম অক্সিস্পোরাম ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট একটি শুষ্ক রোগ। এটি বিশ্বব্যাপী কলা শিল্পের মুখোমুখি সবচেয়ে গুরুতর হুমকিগুলোর মধ্যে একটি, যার কোন প্রতিকার নেই এবং কোন প্রতিরোধী কলার জাত এখনও উদ্ভাবিত হয়নি। পানামা রোগ আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বিধ্বংসী উদ্ভিদ  রোগগুলোর মধ্যে একটি। এটি অনুমান করা হয় যে বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের ৮০ শতাংশ গ্রীষ্মমন্ডলীয় জাতি ৪  থেকে হুমকির মধ্যে রয়েছে। এটি ফুসারিয়াম অক্সিস্পোরাম এফ ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট। এটি মাটি এবং চলমান পানি, খামার সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে।"

এ রোগের প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত না হওয়ায় আক্রান্ত কলা গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং কয়েক বছর ওই জমিতে কলাগাছ লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তা না করলে ভাইরাসটি আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে।”