উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন প্রয়োজন

উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন প্রয়োজন

উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন প্রয়োজন -

পাবনা প্রতিনিধি: দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমা লের জেলাসমূহে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনা থাবায় আক্রান্তের সংখ্যা অস্বাভাবিতভাবে বাড়তে থাকায় বিশেষ করে অন্তত খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে এসব হাসপাতালের অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বড় ধরণের চাপে পড়েছে।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন এবং খুলনা, সাতক্ষীরা ও রাজশাহী অঞ্চলের গণমাধ্যমকর্মীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণামূলক প্রণীত প্রতিবেদনে হাসপাতালসমূহের করোনা রোগীদের জন্য প্রযোজ্য ইক্যুপমেন্ট সম্পর্কে বিরাজমান অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তথ্যমতে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের অনেক হাসপাতালেই হাই-ফ্লো অক্সিজেনের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। শুক্রবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো অক্সিজেন সহায়তার অভাবে রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা (এইচএফএনসি) নামের একটি ডিভাইসের মাধ্যমে সরবরাহ করা হাই-ফ্লো অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বগুড়ার দু’টি হাসপাতালে অন্তত ১৩ জন রোগী মারা গেছেন।

খুব কম অক্সিজেন স্যাচুরেশন থাকা রোগীদের এ ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন দেয়া হয়। কিন্তু, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অনেক হাসপাতালেই ক্রমবর্ধমান রোগীর চাহিদা সামাল দেয়ার মতো পর্যাপ্ত হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা নেই।

গতকাল মারা যাওয়া ১৩ জনের মধ্যে সাতজন মোহাম্মদ আলি হাসপাতালে এবং বাকিরা শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মোহাম্মদ আলি হাসপাতালে আরও অন্তত ১০ জন করোনা রোগী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। হাসপাতালটির ২৫০টি বেডের বিপরীতে বর্তমানে প্রায় ২২৩ জন করোনা রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।  কিন্তু, সেখানে মাত্র দু’টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ডিভাইস আছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট এটিএম নুরুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘অনেক রোগীরই হাই-ফ্লো অক্সিজেন সুবিধা দরকার হচ্ছে। আমরা ১০০টির বেশি নন-রিব্রিদার মাস্ক ব্যবহার করলেও, হাই-ফ্লো অক্সিজেনের অভাবে বয়স্ক রোগীরা দুর্ভোগে আছেন।’

জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাত্র ১২টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ডিভাইস আছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ। ‍গতকাল পর্যন্ত সেখানে ১০২ জন করোনা রোগী চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। এর একদিন আগে, অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়। সরবরাহকারীরা সঠিক সময়ে অক্সিজেন ট্যাংক ভরে দিতে না পারায় এ ঘটনা ঘটে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়তে থাকা করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর তীব্রতা সামলাতে গিয়ে দেশের কয়েকটি বিভাগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে গুরুতর অসুস্থদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় মেডিকেল অক্সিজেন পাওয়া সহজ হচ্ছে না তাদের জন্য।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ন্যাজাল ক্যানুলার সংখ্যা বাড়ানোর হলেও, দেশে মেডিকেল অক্সিজেনের সংকট তৈরি হওয়ার কারণে হাই-ফ্লো অক্সিজেনের দরকার থাকা সব রোগীকে এ সুবিধা দেয়ার সক্ষমতা তাদের নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা রোগী বাড়তে থাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে দৈনিক অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে প্রায় ২০০ টন করা হয়েছে। সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সাধারণ সময়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে দৈনিক প্রায় ১০০ টন অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। তবে, গত বৃহস্পতিবার থেকে এ চাহিদা বেড়ে ২১০ টন হয়ে গেছে।

কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ অক্সিজেনের ৯০ ভাগই সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি বহুজাতিক কোম্পানি। বাকিটা সরবরাহ করে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড ও স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অক্সিজেনের চাহিদা মেটাতে পারছি আমরা। কিন্তু, অক্সিজেন দরকার হওয়া রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন যেভাবে বাড়ছে, তাতে চাহিদা মেটাতে পারব না।’

যোগাযোগ করা হলে লিন্ডে বাংলাদেশের মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, ‘আমরা এখন হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ৯০ থেকে ১০০ টন তরল অক্সিজেন সরবরাহ করছি। এটিই আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা।’

গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই হাই-ফ্লো অক্সিজেনের বিষয়টি গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালে কোনো কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায়, সরকার সব জেলা হাসপাতালগুলোতে এ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয়।

গতকাল পর্যন্ত ৬২টি জেলা হাসপাতালের মধ্যে ৫৬টিতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে, এসব হাসপাতালের বেশিরভাগেরই পর্যাপ্ত হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে এবং বিভিন্ন হাসপাতালের করোনা ইউনিটে এক হাজার ৬৭০টি বেডে এ ধরণের ক্যানুলা সুবিধা যুক্ত আছে। এসব বেডের ৮৪৩টি রাজধানীতে এবং ৫৯টি চট্টগ্রাম শহরে আছে।

রাজশাহী বিভাগে এ ধরণের বেড আছে মাত্র ১০৪টি। এ ছাড়া, খুলনায় ৩০৪টি, রংপুরে ৫৪টি, ময়মনসিংহে ৩৬টি, বরিশালে ৫৬টি, সিলেটে ২১টি এবং চট্টগ্রামে ১৫২টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাযুক্ত বেড আছে।

করোনার নতুন হটস্পট খুলনায় অক্সিজেন সংকট আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খুলনা শহরের তিনটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে, অক্সিজেন সহায়তা দরকার, এমন অনেক রোগীই ভর্তি হতে না পেরে এসব হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। গতকাল এ তিনটি হাসপাতালের ৩২০টি বেডের বিপরীতে ৩৭৯ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।

খুলনা স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা. রাশিদা সুলতানা মনে করছেন, ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ সামাল দেয়ার জন্য বিভাগে এখনো পর্যাপ্ত  চিকিৎসা সুবিধা আছে। বিভাগে মোট ৩০৪টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে বলে দাবি করেন তিনি।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, খুলনা বিভাগে বর্তমানে সক্রিয় হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংখ্যা ১৩১টি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান বলেন, ‘এটি চূড়ান্ত অবহেলা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা।’ 
চলতি বছরের মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সময় থেকে দেশের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সংকট শুরু হয়।

এর মধ্যে ভারতে সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে গত ২২ এপ্রিল থেকে দেশটি শিল্পজাত অক্সিজেন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 

এ অবস্থায় বাংলাদেশে অক্সিজেন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো শিল্পজাত অক্সিজেন উৎপাদন স্থগিত করে পুরো সক্ষমতা দিয়ে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করতে শুরু করে।

ক্যানুলা সংকটের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ মিয়া বলেন, ‘মহামারির আগে এ ডিভাইসটির এতো চাহিদা ছিল না। খুব কমই ব্যবহার করা হতো এটি।’ 

হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাতে প্রতি মিনিটে ৬০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে না পারলে ক্যানুলা বাড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।’