হজ মুসলিম ঐক্যের মহাসম্মেলন

হজ মুসলিম ঐক্যের মহাসম্মেলন

ফাইল ছবি

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম একটি হচ্ছে হজ। হজের মাধ্যমে দুনিয়ার সব মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে। মানুষ এক আদম ও হাওয়া আ:-এর সন্তান হলেও কালপরিক্রমায়এই জাতিতে বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন এসেছে। বর্ণ-গোত্রে, চিন্তা-কর্মে, ভাষায়-বচনে, আচার-আচরণে এমনকি কৃষ্টি কালচারসহ নানাবিধ বিষয়ে এ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আল্লাহ তায়ালা চান সবার মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধন ও ঐক্য অটুট থাকুক। এ জন্য কিছু ইবাদত বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন তিনি। হজ সেগুলোর অন্যতম একটি। হজের মাধ্যমে কিভাবে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য তৈরি হতে পারে তা নিয়েই আজকের আলোচনা।

জিলহজ মাসের নির্ধারিত দিনগুলোতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে কাবা শরিফ ও হজসংশ্লিষ্ট স্থানগুলো জিয়ারত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে বিশেষ কিছু কার্যাবলি সম্পাদন করাকে হজ বলে। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ।

আমরা হজের সময় আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হই। এই ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম প্রধান কাজ। এখানেই পারস্পরিক মতবিনিময় করি। নিজেদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়াদির আদান-প্রদান করি। হজের এই আনুষ্ঠানিকতা বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

রাসূল সা: এই আরাফার ময়দানেই বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: জাতি-ধর্ম, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার মাঝেই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক কামনা করতেন। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পরিসীমার সব স্তরে সেই ভিতও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। বিদায় হজের ভাষণ থেকে তার উজ্জ্বল প্রমাণ পাই। ভাষণে তিনি সবাইকে সতর্ক করে দেন জাহেলিয়াতের কৃষ্টি কালচার থেকে। নিরপরাধ মানুষের রক্তপাতকে হারাম ঘোষণা করেন। প্রথমে তিনি নিজের বংশের পক্ষ থেকে রাবিয়া বিন হারেস বিন আবদুল মোত্তালিবের রক্তের দাবি প্রত্যাহার করে নেন। যা ছিল বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

বিদায় হজের ভাষণে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে সুদকে চিরদিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ জন্য নিজ চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবি প্রত্যাহার করে নেন বিশ্বনবী। সুদ এমন একটি জঘন্যতম জুলুম যার মাধ্যমে সুদখোররা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। অর্থের পাহাড় গড়ে তোলে। অপর দিকে অসহায় অভাবী লোকজন হয় আরো দরিদ্র, হতদরিদ্র। রাসূল সা: বিশ্বমানবতার অর্থনৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ দেখতে চেয়েছেন। সুদ হারাম ঘোষণার মাধ্যমে তা প্রমাণ করেছেন। জাতি উপকৃত হয়েছিল।

দুনিয়ার সব মানুষের জন্য একের ওপর অপরের রক্ত, ধন-সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান আরাফার দিনের মতো সম্মানের বলে ঘোষণা দেন। এ ছাড়াও সবার ধনসম্পদসহ যাবতীয় বিষয়কে হজের হারাম মাসের এবং সম্মানিত নগরীর মতো পবিত্র আমানত বলে সাবধান করেন। ফলে একে অপরের অনিষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভ করে মানব সমাজ। এমনকি যেকোনো মানুষের আমানতগুলো প্রকৃত মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়ারও নির্দেশ দেন বিশ্বনবী। রাসূল সা: হজরত আদম আ:-কে মানবজাতির পিতা উল্লেখ করে, আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের, সাদার ওপর কালোর ও কালোর ওপর সাদার কোনো মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই বলে উল্লেখ করেন। আলোচ্য ঘোষণার মাধ্যমে বংশ-গোত্র বা জাতি-বর্ণ এমনকি রাজা-প্রজার মধ্যকার গৌরব, অহঙ্কার বা শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকার পরিসমাপ্তি ঘটে। একমাত্র নিজেদের তাকওয়া তথা আমলের ভিত্তিতে মর্যাদার উঁচু-নিচুর মাপকাঠি নির্ধারণের ঘোষণা দেন।

নারীদের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করতে জোর তাকিদ দেন। নারীদের ওপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপর নারীদের অধিকারের ঘোষণাও জানিয়ে দেন। সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য যতœশীল হওয়ার নির্দেশ দেন যা নারী-পুরুষের অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা।

মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই উল্লেখ করে তাদের এক অখণ্ড মুসলিম ভ্রাতৃসমাজের ঘোষণা দেন। কোনো ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করতে নিষেধ করেন। একে অপরের ওপর জুলুম না করতে আহ্বান জানান। শয়তান আমাদের বড় কোনো বিষয়ে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে মতপার্থক্য তৈরি করে অনৈক্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করবে বলে সতর্ক করেন। আজ আমরা শয়তানের সেই পাতা ফাঁদে আটকে গেছি। যার কারণে দুনিয়ার সব জায়গায়ই মুসলমানরা অপমানিত, লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত। এ ছাড়াও কোথাও কোথাও আমরা বিতাড়িতও হচ্ছি বটে।

চাকর ও মনিবের মধ্যে এক অনাবিল ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরির তাকিদ পাওয়া যায় বিদায় হজের ভাষণে। মনিবদেরকে গোলাম ও অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করতে জোর দিয়েছেন বিশ্বনবী। নিজেরা যা খাবেন গোলাম ও অধীনস্থদেরও তাই খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন মনিবদের। এমনকি মনিব ও গোলামের মধ্যে পোশাক পরিচ্ছদ পরিধানের ক্ষেত্রেও ইনসাফ রক্ষার নির্দেশিকা জারি করেছেন।

বিশ্বনবী সবাইকে সতর্ক করে বলেন, দুনিয়ার সবাইকে একদিন আল্লাহ তায়ালার কাছে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না, পরস্পর হানাহানিতে মেতে উঠবে না। আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না। আমার সাথে ওহির পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে। হে মানুষ! আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। আমাকেও আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি যতদিন তোমরা এই দু’টি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহর কিতাব ও অপরটি রাসূলের সুন্নাহ। হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমির বা নেতার আনুগত্য করো এবং তার কথা শ্রবণ করো যদিও তিনি হন হাবশি ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তার কথা শুনবে, তার নির্দেশ মানবে ও তার প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবেন, তখন থেকে তার কথাও শুনবে না এবং তার আনুগত্যও করা যাবে না।

হজ মুসলমানদের জন্য এক বিশ্ব সম্মেলন। দুনিয়ার সব দেশ থেকে হজযাত্রীরা সমবেত হন এখানে। সমসাময়িক যাবতীয় প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার দারুণ সুযোগ সৃষ্টি হয় হজের মাধ্যমে। মুসলমানদের এক কাতারে শামিল হওয়ার এই সুযোগ কাজে লাগানো সময়ের দাবি। বিশ্ব মুসলিম নেতারা সেদিকে যত তাড়াতাড়ি নজর দেবেন ততই কল্যাণ।

লেখক : মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর

 পরিচালক, কুঁড়ি সাহিত্য সংসদ, গাইবান্ধা