৪ হাজার কিলোমিটার রেলপথ কেন নিরাপদ নয়!

৪ হাজার কিলোমিটার রেলপথ কেন নিরাপদ নয়!

ফাইল ছবি

ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে একটি ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার পর পুলিশ বলছে দুর্বৃত্তরা রেললাইন গলাতে অক্সিঅ্যাসিটিলিনের ব্যবহার করেছে এবং স্লিপার কেটে ফেলায় অন্তত ১০০ মিটার লাইন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, যার ফলে লাইনটির ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে।

রেল কর্মকর্তারা বলছেন, গাজীপুরের ভাওয়াল স্টেশনের কাছে ওই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হওয়ায় একজন যাত্রী নিহত হয়েছে এবং লাইনটির যেভাবে ক্ষতি করা হয়েছে তাতে আরো বড় দুর্ঘটনার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের ঢাকার রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেছেন, এটি নাশকতা। কারণ রেললাইনকে অক্সিঅ্যাসিটিলিনের মাধ্যমে গলিয়ে ফেলা হয়েছে। এই রেললাইন গলানোর জন্য দুই হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা দরকার হয়।

প্রসঙ্গত, অক্সিজেন ও অ্যাসিটিলিন গ্যাসের মিশ্রণে গঠিত অক্সিঅ্যাসিটিলিন লোহা বা ধাতব পদার্থ গলাতে ব্যবহার করা হয়।

তবে এ ঘটনার পর দেশজুড়ে বিস্তৃত রেললাইনের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে এবং রেল কর্মকর্তারা বলছেন এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো: দিদার আহম্মদ বলেন, রেললাইনকে নিরাপদ রাখতে রেল কর্তৃপক্ষ যেখানে যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার মনে করবেন সেই আলোকেই রেলওয়ে পুলিশ ব্যবস্থাগ্রহণ করবে।

তিনি বলেন, ‘তবে স্থানীয়ভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত হয়ে যারাই ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। গাজীপুরে যারা লাইন কাটার সাথে জড়িত তাদের একজনকে ধরা হয়েছে। বাকিরাও ধরা পড়বে। দেশের সম্পদের ক্ষতি কাউকে করতে দেয়া হবে না।’

রেললাইনের নিরাপত্তা প্রোটোকল
মো: দিদার আহম্মদ বলেন, রেললাইনের নিরাপত্তার জন্য ওয়েম্যান নিয়োজিত থাকে এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রেলওয়ে পুলিশ কাজ করে থাকে।

বাংলাদেশে এখন রেললাইনের দৈর্ঘ্য মোট প্রায় চার হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি। ওয়েম্যান সাধারণত এক একটি দলে বিভক্ত হয়ে প্রতি দুই বা তিন কিলোমিটার করে তদারকি করে।

কোথায় লাইনের কোনো ক্ষতি দেখলে বা অস্বাভাবিক কিছু পরিলক্ষিত হলে তারা রেল কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে পুলিশকে অবহিত করে।

রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, এসব ওয়েম্যানরা রেলওয়ে ট্র্যাকের বিষয়ে খুবই অভিজ্ঞ এবং তারা কাজও করে দক্ষতার সাথে।

মূলত কম পক্ষে পাঁচজন ওয়েম্যানের সমন্বয়ে এক একটি দল প্রতি দুই থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত রেললাইনে সশরীরে টহল দিয়ে থাকে। এছাড়া রেলওয়ে পুলিশ তাদের নিজস্ব সোর্স দিয়েও রেললাইনগুলোর বিষয়ে অবহিত হয়ে থাকে।

অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘ফলে দুর্বৃত্তরা ক্ষতি করার চেষ্টা করলেও সেটা দ্রুতই নজরে আসে এবং সে অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’

রেল কর্মকর্তারা বলছেন, হরতাল অবরোধের মতো রাজনৈতিক সঙ্ঘাতময় সময়ে রেললাইনকে ঘিরে অতিরিক্ত কিছু নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ রেল কর্তৃপক্ষ নিয়ে থাকে। পদস্থ কর্মকর্তারা নিজেরাও গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোর মধ্যবর্তী লাইনগুলো নিজেরা পরিদর্শনে যান।

নিরাপত্তা আরো জোরদার করা হচ্ছে
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অক্টোবরের শেষ দিকে রাজনৈতিক সহিংসতার পর বিভিন্ন কর্মসূচির জেরে সড়ক পরিবহন সীমিত হয়ে পড়লে রেলপথে মানুষের চলাচল আরো অনেক বেড়েছে।

ফলে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি), রেলওয়ে পুলিশ ও পুলিশ বাহিনী ট্রেন যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখতে একযোগে কাজ করছে বলে জানান অসীম কুমার তালুকদার।

কিন্তু এরপরেও প্রায় চার হাজার কিলোমিটার রেলপথের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মহলে।

এমন প্রেক্ষাপটে নতুন করে দুই হাজার ৭০০ আনসার ও দেড় হাজারেরও বেশি ওয়েম্যান নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

অসীম তালুকদার জানান, রাতে ট্রেন অবস্থান করে এমন স্টেশনগুলোতে নতুন করে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া রেলইয়ার্ডগুলোতে সাধারণের চলাফেরা বন্ধ করে নিরাপত্তা কাঠামো জোরদার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি, সবার সহায়তায় রেল চলাচল নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে।’

তবে রেল কর্তৃপক্ষ বা রেলওয়ে পুলিশ যাই বলুক বাস্তবতা হলো খোদ ঢাকা-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রেললাইনেই বাজার বসানো হয়, লোকজনের অবাধে হাটাঁচলা দেখা যায়। যার ফলে অনেক সময় এমন কিছু ঘটে যা কর্তৃপক্ষ টের পেতেও অনেক সময় লাগে।

যদিও রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে রেল ভূমিতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবৈধ অনুপ্রবেশে কর্মকর্তাগন বাধা দেবেন এবং প্রয়োজনে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

এছাড়া রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে এলাকার ভেতর অননুমোদিত কাউকে পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী তাকে আটকের বিধানও আছে।

এমনকি ওই সীমানার মধ্যে গবাদি পশু এলেও তাও আটক করে বিক্রি করে ওই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দেয়ার বিধান আছে।

অথচ বাস্তবতা হলো রাজধানী ঢাকাতেই বেশ কিছু জায়গায় রেললাইনের ওপর বাজার বসানো হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো: আসিফ রায়হান বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে দেশের যেকোনো জায়গাতেই রেললাইনে কোনো কিছু হচ্ছে কি-না সেটা কম্পিউটারের সামনে বসেই জানা সম্ভব।

তিনি বলেন, ‘কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ তো রাইট অফ ওয়েই অর্থাৎ রেললাইন ও সংশ্লিষ্ট এরিয়াকে নিরাপদ রাখাটা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে লাইনের ওপর বাজার বসছে। মানুষ ও পশু বিচরণ করছে। এমন ব্যবস্থাপনায় যেকোনো ধরনের নাশকতার হুমকি তো থেকেই যায়।’
সূত্র : বিবিসি