পরকালীন যাত্রা : প্রস্তুতি ও পাথেয়

পরকালীন যাত্রা : প্রস্তুতি ও পাথেয়

পরকালীন যাত্রা : প্রস্তুতি ও পাথেয়

সব মানুষ পরকালীন যাত্রী। ইহকালীন জীবন শেষে সবাইকে পরকালীন সফরের মুসাফির হতে হয়। রঙিন পৃথিবীর সব মায়া মমতা ত্যাগ করে অফেরা পথে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হয়। সবুজ শ্যামলে ভরা এ জগতে সবারই আগমন একাকী আবার পরকালীন সফরও একাকী। সঙ্গিহীন এ সফরে সব মুসাফিরের প্রস্তুতি ও পাথেয় অতীব জরুরি। অনিশ্চিত গন্তব্যের অচেনা পথে মুসাফিরকে ভাবায়, প্রতিটি ক্ষণই তাকে তটস্থ রাখে। বনি আদমের প্রতিটি মানুষ পরকালীন অবশ্যম্ভাবী যাত্রার নিশ্চিত যাত্রী। তাদের সবার যাত্রার পথ একই রকম।

যাত্রার সূচনা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। পরকালীন যাত্রার প্রথম মঞ্জিল কবর এরপর হাশর এরপর জান্নাত নয়তো জাহান্নাম। পরকালীন যাত্রার এ পথপরিক্রমায় সবাইকেই প্রশ্নের মুখোমুখি, আমলের যাচাই, সব প্রকার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। এ সব ধারায় যে ব্যক্তি কামিয়াব হতে পারবে তার মুক্তি নিশ্চিত অন্যথায় তার জন্য জাহান্নাম ও মর্মন্তুদ সব রকমের শাস্তি সুনির্ধারিত।

যেকোনো সফরের আগে যদি সংশ্লিষ্ট মুসাফির সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, প্রয়োজনীয় পাথেয় জোগাড় করে নিজের সংরক্ষণে রাখে, সফরকালীন সময়ে যাবতীয় বিধি অনুসরণ করে, সহজ ও পরিচিত পথে ভ্রমণ করে তাহলে তার যাত্রা নিশ্চিন্তে আরামদায়কভাবে সমাপ্ত হয়। ঠিক এর বিপরীতে যদি সফর হয় তখন যাত্রীর জীবন মহাসঙ্কটে পড়ে, যাত্রী তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। তখন বিপদ হয় তার নিত্যসঙ্গী।

পরকালীন যাত্রার প্রস্তুতি : আখিরাতের যাত্রায় সব মানুষকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা অতি জরুরি। সব মানুষের আয়ুকাল সুনির্ধারিত। এ কারণে কোনো মানুষই জানে না কার কখন যাত্রার ডাক পড়ে যায়। পরকালীন যাত্রার ডাক আসা মাত্রই সবাইকে জগতের মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমাতে হয়। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন। তারপরও মানুষ অতি-অকৃতজ্ঞ!’ (সূরা হজ, আয়াত-৬৬) তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই মৃত্যুর সময় নির্ধারিত।

আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না। কেউ পার্থিব পুরস্কারের জন্য কাজ করলে তাকে তার পুরস্কার ইহকালে দান করব। আর যদি কেউ পরকালের জন্য কাজ করে তবে তার পুরস্কার সে পরকালে পাবে। শুকরিয়াকারী বান্দাদের কাজের ফল আমি নিশ্চয়ই দেবো।’ (সূরা ইমরান, আয়াত-১৪৫) তিনি আরো বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আমি তোমাদের ভালো ও খারাপ অবস্থা দিয়ে পরীক্ষা করি। আর আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৩৫)

তিনি আরো বলেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহূর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে।’ (সূরা আরাফ, আয়াত-৩৪)। উল্লিখিত আয়াতগুলো এ কথা প্রমাণ করে, যাত্রার সময় সুনির্ধারিত। পরকালীন যাত্রার যাত্রীকে কি প্রস্তুতি নিতে হবে এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লøাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত-২০)

হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আমর ইবনে মায়মুন রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে গণিমত-সুবর্ণ সুযোগ মনে করো। তোমার যৌবনকে কাজে লাগাও বার্ধক্য আসার আগে, তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও তোমার অসুস্থতার আগে, তোমার সচ্ছলতাকে কাজে লাগাও অসচ্ছলতার আগে, তোমার অবসরতাকে কাজে লাগাও তোমার ব্যস্ততার আগে, আর তোমার জীবনকে কাজে লাগাও তোমার মৃত্যু আসার আগে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, তাফসিরে বাগাবি-৫৪৪/৩, মুসনাদে আহমদ) অপর আরেকটি হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘বুদ্ধিমান ব্যক্তি সেই যে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।’ (সুনানে তিরমিজি) পরকালীন যাত্রার সব মুসাফিরের উচিত মৃত্যুর আগেই কবরের সওয়ালের জবাব কী হবে? সে প্রশ্নের উত্তর শিখে নেয়া, কিয়ামত ময়দানের হিসাব-নিকাশের সময় নিজের নেক আমলের পাল্লাকে ভারী করা, সর্বোপরি সে সব কাজে আল্লাহর মহাসন্তুষ্টি লাভ করা যায় সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

পরকালীন যাত্রার পাথেয় : জগতের মায়া ত্যাগ করে যারা মৃত্যুবরণ করে তারা সবাই পরকালীন পথের যাত্রী। পরকালীন যাত্রার সূচনায় কবর নামক মঞ্জিল সবাইকেই অতিক্রম করতে হবে। কবর থেকে হাশর ময়দান এরপর জান্নাত বা জাহান্নাম। পথপরিক্রমার এ ধারায় সব স্তরে আখিরাতের পথিককে ‘পরকালীন যাত্রার পাথেয়’ ব্যবহার বা খরচ করতে হবে। প্রতিটি মঞ্জিলের সূচনায় নির্ধারিত প্রশ্ন বা জবাবদিহিতার আওতায় সবাইকে আসতেই হবে।

এ সব মঞ্জিলে কামিয়াবি কেবল তারাই লাভ করবে যারা দুনিয়ায় থাকাকালীন সময়ে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ও প্রত্যাশিত পাথেয় সংগ্রহ করতে পেরেছে। পরকালীন যাত্রার যাত্রীদের পথেয় কী? এ সম্পর্কে মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘পরকালীন পাথেয় হলো- তাওহিদ ও শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান, বিশুদ্ধ নেক আমল, সর্বাবস্থায় তাকওয়া, সদকায়ে জারিয়া, সুন্নাতের পাবন্দি।

ক. তাওহিদ ও শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান : পরকালীন জীবনে মুক্তির প্রথম ও প্রধান পাথেয় হলো তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা, বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সব প্রকার শিরক থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের উপাস্য হচ্ছেন এক আল্লাহ, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোনো উপাস্য নেই। তিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-১২২)

তিনি আরো বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি প্রতিটি জিনিসের স্রষ্টা। সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদাত করো। আর তিনি প্রতিটি জিনিসের ওপর তত্ত্বাবধায়ক।’ (সূরা আনয়াম, আয়াত-৬) তিনি আরো বলেন, ‘এবং যে ব্যক্তি পরকালীন জীবনের কল্যাণ চায়, সে জন্য চেষ্টা করে এবং সে বিশ্বাসী বা মুমিন হয়; তবে তাদের চেষ্টা ও কর্ম কবুল করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-১৯) তিনি আরো বলেন, ‘সময়ে কসম! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ছাড়া, যারা ঈমান আনে এবং ভালোকাজ করে।’ (সূরা আসর, আয়াত : ১-৩)

খ. বিশুদ্ধ নেক আমল : আল্লাহর জন্য বান্দাহ কর্তৃক সব প্রকার ইবাদতই সংশ্লিষ্ট বান্দার নেক আমল। বান্দার যাবতীয় নেক আমল তার পরকালীন পাথেয়। যে আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হয় এবং আমলনামায় এর সাওয়াব লেখা হয় পরকালীন জিন্দেগির প্রতিটি ধাপে তা উৎকৃষ্ট পাথেয় হিসেবে তা বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে, নেক আমল করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং জাকাত দেয়; তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে পুরস্কার। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৭৭) নেক আমলকারীরা আল্লাহ তায়ালার বন্ধু। যারা আল্লাহর বন্ধু তাদের কোনো ভয় নেই বলে পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রেখো! নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত-৩২)

গ. তাকওয়া : পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ ও সংরক্ষণে তাকওয়ার ভূমিকা অত্যধিক। তাকওয়াবান ব্যক্তি যাবতীয় গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে নেক আমলে রত থাকে, ফলে ওই ব্যক্তির নেকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ করে যে, সে আগামী দিনের জন্য কী সামগ্রীর ব্যবস্থা করে রেখেছে। আল্লাহকেই ভয় করতে থাকো। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সেসব আমল সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করো।’ (সূরা হাশর, আয়াত-১৮)

ঘ. সদকায়ে জারিয়া : পরকালীন পাথেয় হিসেবে সদকায়ে জারিয়ার গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা, সদকায়ে জারিয়ার সুফল মানুষের মৃত্যুর পর চলতে থাকবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেন, ‘একজন মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার আমলনামায় যা থেকে নেকি যোগ হবে; তা হলো- যদি সে শিক্ষা অর্জনের পর তা অপরকে শিক্ষা দেয় ও প্রচার করে, অথবা নেক সন্তান রেখে যায়, অথবা ভালো বই রেখে যায়, অথবা মসজিদ নির্মাণ করে দেয়,অথবা মুসাফিরের জন্য সরাইখানা নির্মাণ করে, অথবা নদী খনন করে দেয় অথবা জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য সম্পদ থেকে সদকা করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস-২৪২)

পরিশেষে মহান আল্লাহপাক আমাদের পরকালীন জীবনের জন্য উত্তম পাথেয় সংগ্রহ করার পাশাপাশি সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক দান করুন।
মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, নোয়াখালী সদর, নোয়াখালী।