তরমুজ কিভাবে ফিলিস্তিনের প্রতীক হয়ে উঠল

তরমুজ কিভাবে ফিলিস্তিনের প্রতীক হয়ে উঠল

তরমুজ কিভাবে ফিলিস্তিনের প্রতীক হয়ে উঠল

‘ফিলিস্তিনে যেখানে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো অপরাধ, সেখানে ফিলিস্তিনের লাল, কালো, সাদা, সবুজ রঙ প্রদর্শনে ইসরাইলি সৈন্যদের বিরুদ্ধে অর্ধেক কাটা তরমুজ তুলে ধরা হয়।’এই কবিতার লাইনগুলো ‘ওড টু দ্য ওয়াটারমেলন’ থেকে নেয়া হয়েছে।কবিতাটি লিখেছেন আমেরিকান কবি অ্যারাসেলিস গিরমে।

এই কবিতায় ফিলিস্তিনকে বোঝাতে এ ফলটিকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়।লাল, কালো, সাদা এবং সবুজ শুধুমাত্র তরমুজ নয়, ফিলিস্তিনের পতাকারও রঙ।এ কারণে গাজায় ইসরাইলের সর্বশেষ আগ্রাসনের মধ্যে ফিলিস্তিনিপন্থী মিছিলে এবং অগণিত সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে এ প্রতীকটি বিশ্ব জুড়ে ব্যবহার করতে দেখা যায়।কিন্তু তরমুজকে রূপক হিসেবে ব্যবহারের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পরে, ইসরাইল যখন গাজা এবং পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, তখন তারা দখলকৃত অঞ্চলগুলোয় ফিলিস্তিনি পতাকা এবং এর রঙের সাথে সাদৃশ্য আছে এমন প্রতীক বহন নিষিদ্ধ করে।পতাকা বহন করা সেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধে পরিণত হয়, ফিলিস্তিনিরা এ কারণে প্রতিবাদ স্বরূপ তরমুজের টুকরো ব্যবহার করতে শুরু করে।১৯৯৩ সালে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে কয়েকটি ধারাবাহিক অন্তর্বর্তী শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয় যা অসলো চুক্তি নামে পরিচিত।

লাল, কালো, সাদা এবং সবুজ রঙের পতাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পতাকা হিসাবে স্বীকৃত ছিল, যা গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।‘একবার গাজা উপত্যকায় কাটা তরমুজ বহন করার জন্য কয়েকজন যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কারণ এভাবে ফিলিস্তিনি পতাকার লাল, কালো এবং সবুজ রঙগুলো প্রদর্শন করা হয়েছিল।’

‘ইসরাইলি সৈন্যরা একসময় মিছিলের সাথে সাথে দাঁড়িয়ে থাকতো এবং মিছিলে কেউ এ সময়কার এই নিষিদ্ধ পতাকা ওড়ালেই তা কেড়ে নেয়া হতো!’অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পরিপ্রেক্ষিতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জন কিফনার তার প্রতিবেদনে এমনটাই উল্লেখ করেছিলেন।

বেশ কয়েক মাস পরে, ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে, পত্রিকাটি জানায় যে ওই প্রতিবেদনে যুবকদের তরমুজ বহনের জন্য যে গ্রেফতারের কথা বলা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করা যায়নি।সেই সাথে এটাও বলা হয়, একজন ইসরাইলি সরকারের মুখপাত্রের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন যে তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

চিত্রকর্মে তরমুজ
এরপর থেকে, শিল্পীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে তরমুজের বৈশিষ্ট্যযুক্ত বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করতে থাকেন।

‌এর মধ্যে খালেদ হুরানির শিল্পকর্মটি সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর একটি। ২০০৭ সালে তিনি ‘সাবজেক্টিভ অ্যাটলাস অব প্যালেস্টাইন’ শিরোনামে একটি বইয়ের জন্য তরমুজের টুকরোর ছবি এঁকেছিলেন।দ্য স্টোরি অফ দ্য ওয়াটারমেলন নামে অভিহিত পেইন্টিংটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করে। এবং ২০২১ সালের মে মাসে ইসরাইল-হামাস সংঘর্ষের সময় থেকে ছবিটি আরো পরিচিত হয়ে ওঠে।এই বছরের শুরুতে তরমুজের চিত্রায়নে আরেকটি জোয়ার দেখা দেয়।

জানুয়ারিতে, ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন গভির পুলিশকে পাবলিক স্পেস বা জনবহুল স্থল থেকে ফিলিস্তিনি পতাকা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।তিনি বলেছিলেন যে এই পতাকা ওড়ানো মানে ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থন করার’ মতো কাজ। তখন ইসরাইল বিরোধী মিছিলে তরমুজের ছবি ব্যবহার হতে দেখা গিয়েছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেটওয়ার্কে
ইসরাইলি আইন ফিলিস্তিনি পতাকাকে বেআইনি ঘোষণা করেনি। তবে পুলিশ এবং সৈন্যদের অধিকার দেয়া হয়েছে, কোনো ক্ষেত্রে তারা যদি মনে করে এটি জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি, তাহলে তারা ওই পতাকা সরিয়ে ফেলতে পারবে।জুলাই মাসে জেরুসালেমে এক বিক্ষোভে, ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনি পতাকার রঙে একটি তরমুজ ধরে প্রতিবাদ করে, যার ওপর লেখা ছিল 'স্বাধীনতা' শব্দটি।ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর বিচারিক সংস্কার পরিকল্পনার প্রতিবাদে আগস্টে, তেল আবিবে বহু মানুষ বিক্ষোভ করেন।

বিক্ষোভে জড়ো হওয়ার সময় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী তরমুজের ছবিযুক্ত টি-শার্ট পরেছিলেন।অতি সম্প্রতি, গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে তরমুজ এবং এর ছবি ব্যবহার করতে দেখা যায়।সম্প্রতি ব্রিটিশ মুসলিম কৌতুক অভিনেতা শুমিরুন নেসা টিকটকে তরমুজের ফিল্টার তৈরি করেন এবং তার ফলোয়ারদের উৎসাহিত করেন তারা যেন তাদের ভিডিও তৈরি করতে ফিল্টারটি ব্যবহার করে।তিনি প্রতিশ্রুতি দেন এ থেকে যে আয় হবে তার সমস্ত অর্থ গাজাকে সাহায্যকারী দাতব্য সংস্থাকে দেয়া হবে।

কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ফিলিস্তিনি পতাকার পরিবর্তে তরমুজ পোস্ট করছেন এই ভয়ে যে তরমুজের পরিবর্তে পতাকা ব্যবহার করলে তাদের অ্যাকাউন্ট বা ভিডিওগুলো হয়তো এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেটওয়ার্কগুলো দমন করতে পারে।সহজ করে বললে, তাদের কন্টেন্টের রিচ কমিয়ে ফেলা হতে পারে।ফিলিস্তিনপন্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা অতীতে ইনস্টাগ্রামের বিরুদ্ধে ‘শ্যাডো ব্যানিং’ এর অভিযোগ এনেছিল।

শ্যাডো ব্যানিং হলো, যখন কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইট বা অনলাইন ফোরাম তাদের একজন ব্যবহারকারীকে তার অজান্তেই ব্লক করে দেয়।এর ফলে সাধারণত তাদের পোস্ট এবং মন্তব্যগুলো অন্য ব্যবহারকারীদের কাছে আর দৃশ্যমান হয় না।এক কথায়, ওই প্ল্যাটফর্মটি নিশ্চিত করে যে ওই ব্যবহারকারীর নির্দিষ্ট কিছু পোস্ট অন্যদের ফিডে প্রদর্শিত হবে না।

কিন্তু বিবিসির সাইবার প্রতিবেদক জো টিডি বলেছেন, এখন যে এমনটা ঘটছে তার কোনো প্রমাণ নেই।‘ফিলিস্তিনপন্থী কন্টেন্ট পোস্ট করা ইউজারদের শ্যাডো ব্যান করার কোনো ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে না,’ তিনি বলেন।‘মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে তরমুজের ছবি ব্যবহার করছে। কিন্তু তারা অবাধে ফিলিস্তিনের পতাকাও ব্যবহার করছে এবং সঙ্ঘাত সম্পর্কে স্পষ্টভাবে লিখছে’, জানাচ্ছেন তিনি।

ফিলিস্তিনে কয়েক দশক ধরে তরমুজ একটি রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, বিশেষ করে প্রথম এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ) উভয় ক্ষেত্রেই।তরমুজ এখন শুধুমাত্র ওই ভূখণ্ডের অসম্ভব জনপ্রিয় খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বরং ফিলিস্তিনি প্রজন্মের জন্য এবং তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের সমর্থনকারীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি