পাকিস্তানে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির সাথে ভারতের যে সম্পর্ক

পাকিস্তানে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির সাথে ভারতের যে সম্পর্ক

পাকিস্তানে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির সাথে ভারতের যে সম্পর্ক

পাকিস্তানে গত কয়েক সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর ফলে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির যুগে সাধারণ পাকিস্তানিদের পক্ষে পেঁয়াজ কেনা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজ সরবরাহে কোনো ব্যাঘাত ঘটায় কিন্তু এই এই দাম বাড়েনি। পেঁয়াজ ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের মতে, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তারা জানিয়েছেন, পাকিস্তানে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ রফতানিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা।

যদিও ভারত থেকে পাকিস্তানে পেঁয়াজ আমদানি করা হয় না। কিন্তু ভারতের পেঁয়াজ রফতানির নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে পাকিস্তানের বাজারে।গত এক মাসে কয়েকটি শহরে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ১৫০ রুপি (প্রায় ৪৫ ভারতীয় রুপি) থেকে বেড়ে কেজিপ্রতি ২৭০ রুপি (প্রায় ৮০ ভারতীয় রুপি) হয়ে গেছে।

ভারত কবে এবং কেন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে?
ভারত গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেডের (ডিজিএফটি) পক্ষ থেকে ৭ ডিসেম্বর একটি নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়েছে, পরদিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকবে।

একইসাথে এও জানানো হয়েছে, নির্দেশিকা জারি করার আগ পর্যন্ত যে কয়টি রফতানির অর্ডার রয়েছে, তা সরবারহ করা যাবে।এর পাশাপাশি রফতানির জন্য যে পরিমাণ পেঁয়াজ ইতোমধ্যে জাহাজে তুলে দেয়া হয়েছে তা সরবরাহ করা যাবে। তবে তা করতে হবে ৫ জানুয়ারির আগে।গত বছর ২৮ অক্টোবর পেঁয়াজ রফতানিতে টনপ্রতি ন্যূনতম ৮০০ ডলার রফতানি মূল্য চালু করে ভারত। প্রাথমিকভাবে এর জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ৩১ ডিসেম্বর। তবে তার আগেই সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেন্দ্র সরকার।

তার কারণ ভারতীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম লাগাম ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে। বাজারে পেঁয়াজের জোগান বাড়িয়ে তার দামে লাগাম টানার উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় সরকার।স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম যেন না বাড়ে এবং অন্যান্য সবজির পাশাপাশি পেঁয়াজের দামও যেন মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকে সে কারণে এই নিষেধাজ্ঞা।

ভারতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে বাজারে টমেটো, পেঁয়াজ এবং অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্র সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।পেঁয়াজ রফতানিতে ভারতের শীর্ষ অংশীদার দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, কাতার, ভিয়েতনাম, ওমান ও সিঙ্গাপুর।

ডিজিএফটি কর্তৃক ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ ভারতের একাধিক প্রতিবেশী দেশে পেঁয়াজের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে।ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে না পাকিস্তান। যদিও ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে দেশটিতে। কিন্তু কেন?

পাকিস্তানে কেন বাড়ছে পেঁয়াজের মূল্য?
‘ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাকিস্তান পেঁয়াজের বড় অর্ডার পেয়েছে,’ জানিয়েছেন আব্দুল ওয়াহিদ আহমেদ, যিনি অল পাকিস্তান ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স-ইমপোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাথে সম্পৃক্ত।তিনি বলেন, ‘বিদেশের বাজারে পেঁয়াজের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ভারত থেকে পেঁয়াজ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই দেশগুলো পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তারা সেখান থেকেই পেঁয়াজ কিনতে নিতে শুরু করেছে।’

ফল ও সবজি রফতানিকারক এবং ব্যবসায়ী শাহজাহান বিবিসিকে বলেন, ‘ভারত যখন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তখন স্থানীয় পাইকারি বাজারে এক মণ পেঁয়াজের দাম ছিল ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার রুপি, যা গত এক মাসে বেড়ে মণপ্রতি নয় হাজার টাকারও বেশি হয়েছে।’পাকিস্তানে পরিসংখ্যান সংস্থা খাদ্যদ্রব্যের সাপ্তাহিক মূল্য সংগ্রহ করে এবং তার ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা হয় ওই দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার।সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ভারত যে সময় পেঁয়াজ রফতানি নিষিদ্ধ করে, সে সময় পাকিস্তানে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল প্রায় ১৫০ রুপি।

এই মূল্য পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন দামের গড়। কিন্তু এক মাস পর সেখানে পেঁয়াজের গড় দাম ২২০ রুপি পর্যন্ত পৌঁছেছে, যদিও পাকিস্তানের কোনো কোনো অঞ্চলে এই দাম ২৭০ রুপি বা তারও বেশি।করাচি ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবল মান্ডি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাহিদ আওয়ান বলেন, এই মুহূর্তে বালুচিস্তানে ফসল শেষ হয়ে গেছে এবং তাদের সরবরাহ করছে সিন্ধ অঞ্চল। তার মতে, পাকিস্তান থেকে যদি এই হারে পেঁয়াজ রফতানি অব্যাহত থাকে, তাহলে দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পাকিস্তানের সরকার কী বলছে?
রফতানির জন্য পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে টনপ্রতি পেঁয়াজের রফতানি মূল্য ১২০০ ডলার রাখা হয়েছে, অর্থাৎ এই দামের চেয়ে কমে পেঁয়াজ বিদেশে পাঠানো যাবে না। আগে পেঁয়াজের রফতানি মূল্য ছিল টনপ্রতি কমপক্ষে ৭৫০ ডলার।যদিও পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পেঁয়াজের স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নজর রাখা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী রফতানি মূল্য আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

রফতানি মূল্য বাড়লে বাজারে পেঁয়াজের দর কমবে?
রফতানি মূল্য টনপ্রতি কমপক্ষে ১২০০ ডলার রেখে পেঁয়াজের স্থানীয় দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান সরকার।

বৈদেশিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ইকবাল তাবিশ বিবিসিকে বলেন, দেশের কোনো পণ্য যাতে খুব বেশি পরিমাণে বিদেশে না যায় সেই কারণে মূল্য নিয়ন্ত্রণের এই পদ্ধতি নেয়া হয়।তিনি বলেন, কোনো পণ্যের রফতানি মূল্য বাড়লে সেটা আমদানির জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্ডার কমে যায়। এর ফলে সেই পণ্য স্থানীয় বাজারে সহজেই পাওয়া যেতে পারে।তবে তার মতে, রফতানি মূল্য না বাড়িয়ে সরকারের উচিত কোটা নির্ধারণ করা যেন বেশি পেঁয়াজ রফতানি না করা যায়।

তিনি বলেন, বিদেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। পাকিস্তানের তিন থেকে চারটি বড় রফতানিকারক সংস্থা রয়েছে যারা বেশি দামে ওই দেশগুলোকে তা বিক্রি করতে পারে এবং এর ফলে দেশে পেঁয়াজের দাম কমবে না।তবে তিনি আব্দুল ওয়াহিদ আহমেদের সাথে একমত নন। তিনি বলেন, রফতানি মূল্য বাড়ায় পেঁয়াজের দাম কমতে পারে এবং এক দিনের ব্যবধানে এই দাম প্রতিদিন এক হাজার টাকা কমেছে।আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এর দাম আরো কমবে বলে আশা করছেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি